তেলকুপীতে প্রাচীন শিখরবংশের পূর্বতন রাজধানী ‘তৈলকম্পী’ অবস্থিত ছিল। সেই সময় মানভূম জেলা শিখরভুম নামে খ্যাত ছিল। শিখরবংশের অপর প্রাচীন রাজধানী পঞ্চকোটগড় থেকে তৈলকম্পীর দুরত্ব ছিল উত্তর-পশ্চিমে ১০.৫ মাইল। শিখরবংশের রাজাদেরই পাঞ্চেতের রাজবংশ বলে অভিহিত করা হয়। এই বংশের রাজা ছিলেন রুদ্রশিখর যিনি অন্যান্য সামন্তরাজাদের সাথে জোট বেঁধে পালবংশের রাজা রামপালকে তাঁর রাজ্য বরেন্দ্রভূমি পুনরুদ্ধার করতে সাহায্য করেছিলেন। নগেন্দ্রনাথ বসুর মতে পঞ্চকোট রাজবংশমালাতে ১০৯৮ খ্রিষ্টাব্দে রুদ্রশিখরের আবির্ভাব হয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় রামপালের রাজত্বকাল ১০৭০-১১২০ বলে উল্লেখ করেছেন। সন্ধ্যাকর নন্দী রচিত সংস্কৃত কাব্যগ্রন্থ রামচরিতম কাব্যগ্রন্থের এই কয়েকটি লাইনে রুদ্রশিখরের বর্ণনা পাওয়া যায় :-
“শিখর ইতি সমর পরিসর বিসর দরিরাজ রাজিগত্ত গধ্বগহন দহন দাবানল: তৈলকম্পীয় কল্পতরু রুদ্রশিখর”
রামচরিতম প্রাচীনতম গ্রন্থ যেখানে রুদ্রশিখরের উল্লেখ পাওয়া যায়। বাংলায় এই কয়েক লাইনের অর্থ দাঁড়ায়- “যুদ্ধে যার প্রভাব, নদী-পর্বত ও উপান্তভূমি জুড়ে ছড়িয়ে আছে, পর্বত কন্দরের রাজবর্গের যিনি দর্প দহনকারী দাবানলের মতো সেই তৈলকম্পের কল্পতরু রুদ্রশিখর।
মন্দিরের পাওয়া বিবরণ:
১৮৯৬ সালে অবিভক্ত বাংলার পূর্ত বিভাগের দ্বারা সংকলিত বাংলার প্রাচীন সৌধের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয় যা ৩১শে আগস্ট ১৮৯৫ পর্যন্ত সংযোজিত করা ছিল। এখানে তেলকুপীর মন্দিরের শুধুমাত্র বেগলারের বর্ণিত প্রথম মন্দির সমষ্টির ১৩টি মন্দিরের উল্লেখ করা হয়। মন্দিরের গঠনশৈলীর বর্ণনা দিতে গিয়ে বলা হয় যে এই স্থাপত্য বড় বড় পাথর নিখুঁত আকারে কেটে সূক্ষ্ম ভাবে জোড়া দিয়ে তৈরী করা হয়েছে। এখানে কোনও পেষণী বা হামানদিস্তার সাহায্য নেওয়া হয়নি। পাথরগুলি ঠিকমতো স্থাপনা করার পর সেগুলিকে ভাস্কর্যমণ্ডিত করা হয়েছে। বিভিন্ন জায়গার ফাঁকগুলি পাথর দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। যেখানে ফাঁকগুলি একটু বেশি বড় সেখানে স্থাপত্যকলার করবেলিং পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া হয়েছে। মন্দিরের গোলাকার গম্বুজগুলি এই পদ্ধতিতেই তৈরী করা হয়েছে। এখানে একটিমাত্র খিলানযুক্ত প্রবেশপথ পাওয়া গিয়েছে যা কিনা মন্দিরগুলি পৃথক করবার জন্য পরবর্তী কালে তৈরী করা হয়েছিল। এই তালিকায় উল্লেখ করা হয় যে মন্দিরগুলি যোগল আমলের পরবর্তী যুগের শুরুর দিকে তৈরী হয়েছিল। এখানে শৈব আর বৈষ্ণব দুই সম্প্রদায়ের মন্দির আছে, কারণ এখনে শিবলিঙ্গ, গনেশের মূর্তি ও বিষ্ণুর বিভিন্ন মূর্তি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এই তালিকায় আরও উল্লেখ করা হয় যে মানভূম জেলাতে তেলকুপীর যত বিস্তীর্ণ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আর কোথাও নেই।